রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে জন্মেছিলেন, কলকাতায় তখন রথ দৈনন্দিন ব্যবহারের মধ্যে সচল ছিল না। অশ্বচালিত নানারকম যানবাহন তখনও রাজধানীর রাস্তায় পুরোদমে চলছে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে প্রাগাধুনিক রথের সেই রাজকীয় গাম্ভীর্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রথ তার রাজত্ব বজায় রেখেছিল একটিমাত্র বাৎসরিক পার্বণে… আষাঢ় মাসে জগন্নাথের রথযাত্রায়। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) নিজে ব্রাহ্ম পরিবারের মানুষ, ছোটোবেলায় ভাইবোনেদের সঙ্গে খুদে রথ টানার আনন্দ কিংবা বড়োবেলায় রথারূঢ় জগন্নাথকে ভক্তিনম্র দর্শন, কোনও অভিজ্ঞতাই তাঁর জীবনে প্রত্যক্ষ বলে তাঁর জীবনী, বা আত্মজীবনীগুতে দৃঢ় সাক্ষ্য আমরা পাইনি। অথচ রথের চিত্রকল্প তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে ভরপুর। এবং সেই সমস্ত রথোল্লেখ বাঙালির সর্বজনীন রথযাত্রার আমেজ থেকে শুরু করে মহাকাব্যিক চিরন্তনতা অবধি বিপুল পরিসর জুড়ে সুবিস্তৃত। আসুন, তারই কয়েকটি নিদর্শন আরেকবার ফিরে পড়া যাক।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার শিশু কথক এবং শিশু চরিত্রদের স্বল্পজীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে রথ এবং রথযাত্রা স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। সেই অভিজ্ঞতায় ভক্তির আবেগ কিংবা ব্যায়বাহুল্যের আড়ম্বর নেই, আছে সরল আনন্দের অনাবিল উচ্ছ্বাস।
‘পুতুল ভাঙা’ কবিতার সেই শিশুটির কথন… “মা গো, তুমি পাঁচ পয়সায় এবার রথের দিনে সেই যে রঙিন পুতুলখানি আপনি দিলে কিনে…”। রথের মেলা থেকে মায়ের সেই স্বল্পমূল্যে কেনা উপহারটি তার কাছে বিষম দামি, গুরুমশাইয়ের কোপে পড়ে সেটি নষ্ট হয়েছে, মায়ের কাছে তাই শিশু এসেছে কাতর অভিযোগ নিয়ে।
‘ছোটোবড়ো’ কবিতার যে শিশু বড় হয়ে বাবার মতো হতে চায়, এবং শৈশবের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে চায়, তার বিভিন্ন স্বপ্ন-সংকল্পের একটি হল, “রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয়/ একলা যাব, করব না তো ভয়–“। শিশুটি বলছে, সেই সময়ে মামা যদি ছুটে এসে বলেন, “হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো…” তক্ষুনি সে মামাকে বলে দেবে, সে বাবার মতো বড় হয়ে গিয়েছে, রথের মেলার মতো জনাকীর্ণ স্থানে একা একা গেলেও এখন আর তার কোনও ভয় নেই। কিংবা ‘পুতুল ভাঙা’ কবিতার সেই শিশুটির কথন… “মা গো, তুমি পাঁচ পয়সায় এবার রথের দিনে/ সেই যে রঙিন পুতুলখানি আপনি দিলে কিনে…”। রথের মেলা থেকে মায়ের সেই স্বল্পমূল্যে কেনা উপহারটি তার কাছে বিষম দামি, গুরুমশাইয়ের কোপে পড়ে সেটি নষ্ট হয়েছে, মায়ের কাছে তাই শিশু এসেছে কাতর অভিযোগ নিয়ে। ‘রাজা ও রানী’ কবিতার শিশু কথকটি অবাধ্যতার জন্য রাজ-প্রতিম পুরুষ অভিভাবকের কাছে শাস্তি পেয়েছে, পেয়ারা পেড়ে আনা এবং চিঁড়ের পুলি খাওয়ার পাশাপাশি “রথ দেখতে যাওয়া”-র ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন কঠোর অভিভাবক৷ এইভাবে, ‘শিশু’ এবং ‘শিশু ভোলানাথ’ দুটি কাব্যগ্রন্থেই বারংবার ফিরে এসেছে রথ এবং রথযাত্রা-কেন্দ্রিক উচ্ছ্বাস, অথবা সেই আমোদ থেকে বঞ্চিত হবার খেদ।
আবার, বড়দের চোখ দিয়ে শিশুদের দেখা হচ্ছে, এমন কবিতাতেও এসেছে রথের প্রসঙ্গ। ‘ক্ষণিকা’ বইয়ের ‘সুখদু:খ’ কবিতা শুরু হচ্ছে এইভাবে… “বসেছে আজ রথের তলায়/ স্নানযাত্রার মেলা–“। সেই মেলায় এক পয়সা দিয়ে তালপাতার বাঁশি কিনে বাজাচ্ছে যে মেয়েটি… তার হাসিটিই কবি-কথকের চোখে সবচেয়ে আনন্দময় হয়ে ধরা দিয়েছে। আবার, এর বিপ্রতীপে যে ছেলেটি একটি রাঙা লাঠি কেনার পয়সাও জোগাড় করে উঠতে পারেনি, তার কারুণ্যভরা চোখদুটিও কবির নজর এড়িয়ে যায়নি৷
ছোটোদের নিয়ে কবিতার পর, এবার বড়দের নিয়ে কবিতার পরিসরে প্রবেশ করা যাক। রবীন্দ্রনাথের ভক্তিরুচ্ছ্বসিত কবিতা এবং গানগুলির দিকে তাকালে সহজেই নজরে পড়বে, তাঁর চেতনায় ঈশ্বর প্রায়শই হয়ে উঠেছেন এক রথারূঢ় রাজাধিরাজ। যেমন, ভীষণ পরিচিত ‘কৃপণ’ কবিতাটির ভিক্ষুক-কথক লীলারহস্যময় ঈশ্বরকে “স্বর্ণরথে”-র আরোহী-রূপেই দেখেছে, এবং প্রত্যাশা করেছে যে রাজার ছড়িয়ে দেওয়া ধনধান্য মুঠো-মুঠো কুড়িয়ে নেবার সৌভাগ্য বুঝি দূরে নেই! কিন্তু তাকে বিস্মিত করে, রাজার রথ তারই সামনে এসে থেমেছে, রাজা স্বয়ং হাত পেতেছেন তার কাছে ভিক্ষা নেবেন বলে। হতচকিত, বিভ্রান্ত ভিক্ষুক রাজাকে একটি ছোটো শস্যকণা ভিন্ন আর কিছু দিতে পারেনি। পরে, ঘরে এসে ভিক্ষার ঝুলিতে একখণ্ড স্বর্ণকণা দেখে সে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে ধিক্কার দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। (অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য বলে রাখা ভাল, এই কবিতার সম্ভাব্য অনুপ্রেরণা হল ভাগবতের শিশুকৃষ্ণ ও ফলওয়ালির গল্প। গল্পটি রবীন্দ্রনাথের এতই প্রিয় ছিল যে, ‘পদরত্নাবলী’-র ছোট্ট পরিসরের মধ্যেও তিনি এই কাহিনি-ভিত্তিক একাধিক পদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন।)